
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি রাজধানীর ফার্মগেট কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী জাতীয় সংলাপ-২০২৪ এর উদ্বোধনী ভাষণে তরুণদের শক্তি এবং নির্বাচনী সংস্কারের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তরুণরা সংখ্যায় বেশি এবং তারা দেশের ভবিষ্যত নিয়ে আগ্রহী, তাই তাদের মতামত গ্রহণের জন্য ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারণ করা উচিত। ড. ইউনূস তরুণদের ক্ষমতায়নের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বলেন, “যত বেশি তরুণ, তাদের মধ্যে পরিবর্তনের প্রতি আগ্রহ তত বেশি। তরুণরা তাদের শক্তি দিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে এবং তথ্যপ্রযুক্তির সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক তাদেরকে আরও শক্তিশালী করছে। তাদের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যত আরও সুদৃঢ় হবে।”
তিনি নির্বাচনী সংস্কারের প্রসঙ্গে বলেন, নির্বাচনে তরুণদের অংশগ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “নির্বাচন কমিশন হয়তো ভিন্ন বয়স সুপারিশ করবে, তবে আমি তরুণদের দ্রুত ভোটার করার পক্ষে,” বলেন ড. ইউনূস। তিনি বিশ্বাস করেন যে তরুণদের ভোটাধিকার দেওয়া দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে আরও শক্তিশালী করবে এবং পরিবর্তনের একটি নতুন যুগ সূচিত করবে। অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা প্রয়োজন এবং এ জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। “সংস্কারের জন্য আমাদের মধ্যে ঐকমত্য প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন সেই বয়স নির্ধারণ করবে, যা দেশের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হবে,” তিনি মন্তব্য করেন।
এছাড়া, ড. ইউনূস সংস্কারের বিষয়ে আরো বলেন, “নির্বাচন কমিশন যে বয়স সুপারিশ করবে, তা আমার পছন্দ নাও হতে পারে, তবে যদি দেশের অধিকাংশ মানুষ সেটি গ্রহণ করে, আমি তা মেনে নেব।” তিনি উল্লেখ করেন, সংস্কারের মহাযজ্ঞে দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। “সংস্কারের কাজ আমাদের প্রত্যেককে পালন করতে হবে, যার যার অবস্থান থেকে,” তিনি বলেন।
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেবল বাংলাদেশকে মুক্ত করেনি, বরং আমাদের স্বপ্নকে তুমুল সাহসী করেছে। “বাকহীন বাংলাদেশ আজ জোরালো কণ্ঠে কথা বলার শক্তি ফিরে পেয়েছে এবং এই কণ্ঠ ঐক্য গঠনে সোচ্চার হয়েছে,” তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের ঐক্য আরও শক্তিশালী হয়েছে, এবং এটি আমাদের অসাধ্য সাধন করতে সাহায্য করবে। আমাদের এখনই সর্বোচ্চ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি বৈষম্যহীন অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য সম্পদ ও সুযোগের সমতা থাকবে।”
প্রধান উপদেষ্টা তরুণদের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বলেন, “কোনো নাগরিকই তার অবস্থান বা পরিচয়ের কারণে বৈষম্যের শিকার হবে না। রাষ্ট্রের আয়োজনে প্রত্যেক নাগরিকের সৃজনশীলতা বিকশিত হবে এবং তারা যে কোনো পর্যায়ের উদ্যোক্তা হতে পারবেন।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, “যে কোনো নাগরিক, নারী কিংবা পুরুষ, তাদের কর্মজীবন বেছে নিতে পারবেন, এবং রাষ্ট্রের উচিত তাদের সেই সুযোগ প্রদান করা।”
তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে বলেন, “আমাদের সমাজে এখন আর কোন ব্যক্তি বন্দনার সুযোগ থাকবে না। রাষ্ট্রের আয়োজনে সবার জন্য একসাথে উন্নতি সাধনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু পরিচিতি অর্থহীন হয়ে যাবে এবং সবাই একে অপরকে সমান অধিকারী হিসেবে দেখতে শিখবে।” তিনি তরুণ-তরুণীদের এ দায়িত্ব পালনে প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানান, যাতে তারা শুধু দেশের মঙ্গল নয়, বিশ্বের মঙ্গলেও অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
অধ্যাপক ইউনূস ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের স্মরণ করে বলেন, “আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সকল যোদ্ধাদের। বিশেষ করে আমি অভিবাদন জানাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ছাত্র-জনতাকে। যারা আহত হয়েছেন, তাদের প্রতি আমাদের ঋণ শোধ হওয়ার নয়।” তিনি আরও বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের রূপান্তর পর্বে প্রবেশ করার অধিকার অর্জন করেছি এবং আমাদের সকল শক্তি দিয়ে সেই রূপান্তর দ্রুত সফলভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে।”
ড. ইউনূস সংস্কারের কাজের দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে চান। “এখন আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যে, সকলের মতামত নিয়ে দ্রুত একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে চাই, যাতে সংস্কারের কাজ দ্রুত শেষ করা যায় এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়,” তিনি বলেন।
এছাড়া, সংস্কারের কাজে নাগরিকদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, “যারা ভোটার, তারা তো অংশগ্রহণ করবেনই, তার সঙ্গে যারা ভবিষ্যতে ভোটার হবেন তারা যেন সংস্কারের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন।” তিনি জানান, ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং তাদের প্রতিবেদন জানুয়ারি মাসে পাওয়া যাবে। “এটি নাগরিকদের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে সংস্কারের কাজ সহজ করবে,” তিনি বলেন।
অধ্যাপক ইউনূস শেষ পর্যন্ত সকল নাগরিককে আহ্বান জানান, যাতে তারা এই সংলাপের মাধ্যমে একটি কার্যকর এবং গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেন। “সংলাপের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে আমরা সকলের সহযোগিতা কামনা করছি,” তিনি বলেন।