ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে চলেন দুজন। চাকরি নিয়েছেন কাছাকাছি জায়গায়। ছুটির দিনে আড্ডায়-গল্পে সময় কাটাবেন বলে বন্ধু শাহাদাত হোসেনের (১৮) বাসায় আসেন ইসমাইল হোসেন (১৮)। শাহাদাত চাকরি করতেন রিয়াজউদ্দিন বাজারের মোহাম্মদীয়া প্লাজার আজওয়ার টেলিকমে। ওই ভবনের পঞ্চমতলায় বাসা তাঁর। ইকবালের চাকরি পাশের বিনিময় টাওয়ারে। শুক্রবার মার্কেট বন্ধ, তাই বৃহস্পতিবার রাতেই দুই বন্ধু একত্র হন শাহাদাতের বাসায়। তবে এটিই যে দুই বন্ধুর একসঙ্গে কাটানো শেষ দিন হবে, সেটি তাঁরা ভাবেননি।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে লাগা আগুনের ধোঁয়ায় দম আটকে একসঙ্গে মারা যান দুই বন্ধু। রিয়াজউদ্দিন বাজারের রিজওয়ান কমপ্লেক্স ও মোহাম্মদীয়া প্লাজার মধ্যবর্তী অংশে একটি দোকানে আগুন লাগে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। মোহাম্মদীয়া প্লাজার পঞ্চমতলার বাসাতে ছিলেন শাহাদাত ও ইসমাইল। ধোঁয়ার কারণে বের হতে পারেননি কেউ।
শাহাদাত ও ইসমাইলের জন্ম সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের কুতুবপাড়া এলাকায়। বেড়ে ওঠাও সেই গ্রামে। দুই বছর আগে দুজনের কর্মজীবনও একসঙ্গে শুরু। পৃথিবী থেকে বিদায়ও নিলেন একই সঙ্গে। তাঁদের দাফন করা হয়েছে একই কবরস্থানে পাশাপাশি।
আজ শুক্রবার বিকেলে শাহাদাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মা খুরশিদা আক্তার অজ্ঞান অবস্থায় খাটে শুয়ে আছেন। ছেলে হারিয়ে তিনি যেন সব হারিয়ে ফেলেছেন। একই অবস্থা দেখা গেল ইসমাইলের বাড়িতেও। তাঁর বাবা সৈয়দ আহমদ বিষণ্ন মনে বাড়ির এক পাশে বসে আছেন। কারও সঙ্গে কোনো কথাই বলছেন না। শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছেন।
দুজনের বাড়ির পাশেই স্থানীয় জামে মসজিদ ও কবরস্থান। ওই কবরস্থানে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে দুই বন্ধুকে। কথা হয় তাঁদের বন্ধু মো. জুবায়েরের সঙ্গে। তিনি টেরিবাজার এলাকায় জুতার দোকানে কাজ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তিনজনই একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। ঈদুল আজহার পর একসঙ্গে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। এখন তারা নেই।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, রাত দেড়টার দিকে আগুনের খবর পেয়ে নগরের নন্দনকানন, চন্দনপুরা, আগ্রাবাদ ও লামার বাজার ফায়ার স্টেশনের আটটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। আজ শুক্রবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, মোহাম্মদীয়া প্লাজার ব্রাদার্স টেলিকম নামের দোকানে শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত।
আগুনে মো. রিদুয়ান (৪৫) নামে আরও এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া মেরিনা পারভিন (৩৫) ও তাঁর মেয়ে জান্নাতুল আক্তার (৯) আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
আগুন লাগার পর আহত ও নিহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করেন স্থানীয় দোকানিরা। স্থানীয় লোকজন বলছেন, মুঠোফোনের ব্যাটারির কারণে আগুনের কালো ধোঁয়া বেশি ছিল। দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগলেও ধোঁয়া দ্রুত পাঁচতলায় উঠে যায়। ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়েই প্রাণ গেছে তিনজনের। তাঁরা সবাই বাজারের বিভিন্ন দোকানে কাজ করতেন। মার্কেটের পাঁচতলায় মূলত তাঁরা ভাড়া থাকতেন।
সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রিয়াজউদ্দিন বাজারের মোহাম্মদীয়া প্লাজার দ্বিতীয় তলার ব্রাদার্স টেলিকম দোকানটির বেশির ভাগ মালপত্র পুড়ে গেছে। সেখানে মুঠোফোন ঠিক করার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও ব্যাটারি, চার্জার পড়ে আছে। পুরো মার্কেটেই ধোঁয়ার ঝাঁজালো গন্ধ। পাঁচতলার কক্ষগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, আগুনের ধোঁয়ায় মৃত পড়ে আছে দুটি বিড়াল। পুরো কক্ষে চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছিল ধোঁয়ার কারণে।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, এলাকাটি খুবই ঘনবসতিপূর্ণ। ফলে ধোঁয়া দ্রুত ছড়িয়ে যায়। আগুন নেভানো গেলেও ধোঁয়ার কারণে নিশ্বাস আটকে ওই তিনজন মারা গেছেন। এর আগেও রিয়াজউদ্দিন বাজারে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। বারবার দোকানমালিক সমিতিকে বলা হলেও তারা মার্কেটের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে সতর্ক হচ্ছে না।