“রাত থেকে এখন পর্যন্ত না খেয়ে আছি। ১৯৮৮ সালের পরে এত বড় বন্যা আমি আর দেখি নাই।”
ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ফেনীর মুহুরী নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে জেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এছাড়া বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন এক যুবক।
ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম জানান, ভারি বর্ষণ ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে
মঙ্গলবার সকাল ৯টায় মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ১২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এর আগে সোমবার রাতে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। রাতেই মুহুরী বাঁধের একটি স্থান ভেঙে ফুলগাজী বাজার পানিতে তলিয়ে যায়।ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কে তিনফুট পানি উঠে বন্ধ হয়ে যায় ছোট যান চলাচল।
আবুল কাশেম বলেন, রাতেই ফুলগাজী উপজেলার উত্তর দৌলতপুর অংশে মুহুরী বাঁধের আরও পাঁচটি স্থান ভেঙে অন্তত দশটি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে কয়েক শতাধিক পরিবার।
ফুলগাজী সদর উপজেলার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মাঈন উদ্দিন খোকন বলেন, মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে উত্তর দৌলতপুর, দক্ষিণ দৌলতপুর, বনিকপাড়া, মালিপাথর, শালধর ও দেড়পাড়াসহ অন্তত দশটি গ্রামের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ওইসব স্থানের ঘর-বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শতশত মানুষ।
ফুলগাজী উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের নুরুল করিম বলেন, সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার ঘর সংলগ্ন মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। এতে তার টিনের চালার ঘরটি পানিতে ভেসে যায়।
তিনি বলছিলের, “ঘরের সব আসবাবপত্র পানিতে চলে গেলেও দুই শিশু সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে কোনোমতে বেঁচে ফিরেছি। বেঁচে থাকার একমাত্র ঘারটি হারিয়ে এখন আমি নিঃস্ব।”
একই উপজেলার সিদরাতুল মুনতাহা নামের এক স্কুল শিক্ষার্থী বলেন, “পানিতে আমার বই-খাতা সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। শুধু পরনের কাপড় ছাড়া ঘর থেকে আর কিছুই বের করতে পারি নাই।”
দক্ষিণ দৌলতপুর গ্রামের ৭৫ বছর বয়সী ছকিনা আক্তার বলেন , “পানির প্রবল তোরে ঘরের সব মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রান্না করার পাতিল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। প্রতিবন্ধী দুই সন্তান নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে ফিরছি।”
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “সোমবার রাত থেকে এখন পর্যন্ত না খেয়ে আছি। ১৯৮৮ সালের পরে এত বড় বন্যা আমি আর দেখি নাই।”
উত্তর দৌলতপুরের সত্তোরর্ধ বৃদ্ধ আবুল কালাম বলছিলেন, “বাঁধ ভেঙে ঘরে পানি ঢুকে গেছে। আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। দুই ছেলে মেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়ে গতকাল রাত থেকে দুর্ভোগে আছি।”
ফুলগাজী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সেলিম বলেন, “ভারতীয় ঢলের কারণে মুহুরী নদীর পানি বেড়ে ফুলগাজী বাজারে প্রবেশ করেছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বাঁধের আরও স্থান ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এখনও নদীর পানি বাড়ছে।”
এদিকে বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের পূর্ব ঘনিয়ামোড়া এলাকায় মো. মামুন নামে ২৫ বছর বয়সী এক যুবকের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যার হারুন মজুমদার। মামুন কিসমত ঘনিয়ামোড়া এলাকার আবদুল মান্নানের ছেলে।
ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ শাহরিয়ার বলেন, মুহুরী-কহুয়া-সিলোনীয়া নদীর দুপাশে ১২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। বাঁধের যে কয়েকটি স্থান ভেঙেছে, পানি নেমে গেলে সেই স্থানগুলো মেরামত করা হবে।
ফেনী জেলা প্রশাসক মোছাম্মদ শাহীনা আক্তার বলছিলেন, জেলা প্রশাসন থেকে নিয়মিত মনিটর বরা হচ্ছে।যেসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওইসব এলাকা পরিদর্শন করছেন। দুর্যোগ মোকাবিলায় শুকনো খাবারসহ অন্যান্য সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।
পানিবন্দিদের শুকনো খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া ভূঁইয়া জানিয়েছেন।
ফেনী-১ আসনের সাংসদ আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম বলেন, বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে তিনি ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলো ঘুরে দেখেছেন। মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীতে স্থায়ী টেকসই বাঁধধ নির্মান প্রকল্পটি চলতি বছর একনেকে পাশ হলে কাজ শুরু হবে।
প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে ভারতের উজানের পানিতে মুহুরী, কুহুয়া এবং সিলোনিয়া নদীর বাঁধেরর বিভিন্ন স্থান ভেঙে ফুলগাজী-পরশুরাম উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। নিঃস্ব হয় নদী তীরবর্তী মানুষজন।